বাইশে হারালাম যাদের

ছবি: সংগৃহীত

করোনা তান্ডবে একদমই ভালো যায়নি ২০২০ সাল। চারদিকে অগণিত মৃত্যুর রেশ ছিল ২০২১-এও। ২০-এর মতোই ২১-এও আমরা হারিয়েছে অনেক নক্ষত্রকে। ভেবেছি হয়তো ২০২২-এ ঘুরে দাঁড়াবো। কিন্তু নতুন বছরেও পতন হয়েছে নক্ষত্রের। অশ্রুসিক্ত চোখে চিরবিদায় দিতে হয়েছে তাদের।

বাপ্পী লাহিড়ী

১৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ভারতের মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও সুরকার বাপ্পী লাহিড়ী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। গত বছর এপ্রিলে করোনা আক্রান্ত হয়ে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বাপ্পী লাহিড়ী। কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে বাড়িও ফেরেন তিনি। আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে সোমবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

১৯৭০ থেকে ৮০-এর দশকে হিন্দি ছায়াছবির জগতে অন্যতম জনপ্রিয় নাম বাপ্পী লাহিড়ীর। হিন্দিতে ‘ডিস্কো ডান্সার’, ‘চলতে চলতে’, ‘শরাবি’, বাংলায় অমর সঙ্গী, আশা ও ভালবাসা, আমার তুমি, অমর প্রেম প্রভৃতি ছবিতে সুর দিয়েছেন। গেয়েছেন একাধিক গান। ২০২০ সালে তাঁর শেষ গান ‘বাগি- ৩’ এর জন্য। কিশোর কুমার ছিলেন বাপ্পীর সম্পর্কে মামা। বাবা অপরেশ লাহিড়ী ও মা বাঁশরী লাহিড়ী— দু’জনেই সঙ্গীত জগতের মানুষ। ফলে একমাত্র সন্তান বাপ্পী ছেলেবেলা থেকেই গানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। মা, বাবার কাছেই পান প্রথম গানের তালিম। মা-বাবা নাম দিয়েছিলেন অলোকেশ, কিন্তু জনপ্রিয়তা পান বাপ্পী নামে।


লতা মঙ্গেশকর

২৭ দিনের লড়াই শেষ করোনার কাছে হেরে গেছেন ভারতীয় উপমহাদেশের সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮ টা ১২ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। করোনা আক্রান্ত হওয়ায় গত ১১ জানুয়ারি তাকে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত ছিলেন তিনি। প্রথম থেকেই তাকে আইসিইউ-তে রাখা হয়েছিল। ৩০ জানুয়ারি শিল্পীর কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। কিন্তু বয়সজনিত নানা সমস্যার কারণে শেষ পর্যন্ত আর লড়তে পারলেন না তিনি। 

এর আগেও সঙ্কটজনক অবস্থায় একাধিক বার হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল লতাকে। কিন্তু ভক্তদের আশ্বস্ত করে প্রত্যেকবারই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন।


কাজী আনোয়ার হোসেন

গত ১৯ জানুয়ারি বিকেলে মৃত্যুবরণ করেন সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার ও রহস্যভেদী মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন কাজী আনোয়ার হোসেন। গত ১০ জানুয়ারি থেকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।

কাজী আনোয়ার হোসেন একাধারে লেখক, অনুবাদক, প্রকাশক। ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন বরেণ্য এই লেখক। তার পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম ‘নবাব’। তার পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মাতা সাজেদা খাতুন।


নারায়ণ দেবনাথ

গত ১৮ জানুয়ারি ৯৭ বছর বয়সে ভারতের বেলভিউ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বাংলা কমিকস্ জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র নারায়ণ দেবনাথ।

বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাহাদুর বেড়াল প্রভৃতি চরিত্রের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ সব বয়সের পাঠকের মনে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে ২০১৩ সালে ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মান প্রদান করে। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, পদ্মশ্রী সম্মান, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার ছাড়াও তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি লিট ডিগ্রি পান। 


সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। 

গানে তার হাতেখড়ি হয় পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, চিন্ময় লাহিড়ির কাছে। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি, এমনকি তার পুত্র উস্তাদ মুনাবর আলি খানের কাছেও শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৪৮ সালে প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। ক্লাসিক্যাল সংগীতের পাশাপাশি সিনেমা জগতেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানের সংখ্যা কম নয়। 

‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘এ শুধু গানের দিন’, ‘এ লগন গান শোনাবার’, ‘মধুমালতি’, ‘এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে’, ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব’, ‘তুমি না হয়’, ‘যমুনা কিনারে’, ‘চম্পা চামেলি গোলাপেরই বাগে’, ‘আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি’… এমন অনেক কালজয়ী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।

বাংলা সিনেমার পাশাপাশি ১৭টি হিন্দি সিনেমাতেও প্লেব্যাক করেছেন তিনি। পাশাপাশি আধুনিক গানের নিজস্ব অ্যালবামও বের করেছেন। শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি, অনিল বিশ্বাস, মদন মোহন, রোশন প্রমুখ সহ আরো অনেক বিখ্যাত সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন।

১৯৭১ সালে ‘জয়জয়ন্তী’ ও ‘নিশিপদ্ম’ সিনেমায় গান গেয়ে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে ভারতের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন মুখোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে ২০১১ সালে ‘বঙ্গবিভূষণ’, ২০১২ সালে ‘সংগীত মহাসম্মান’ ও ২০১৫ সালে ‘ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি বিশেষ সংগীতসম্মান’ প্রদান করে। এছাড়া তিনি ‘গীতশ্রী’ সম্মান, ভারত নির্মাণ অ্যাওয়ার্ড, ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ড সহ বহু সম্মানে ভূষিত হন। 


শাঁওলি মিত্র
 
পশ্চিমবঙ্গের মঞ্চ আর সিনেমার প্রখ্যাত অভিনেত্রী শাঁওলি মিত্র চিরবিদায় নিলেন সবার চোখের আড়ালে থেকে, ঠিক তার বাবা শম্ভু মিত্রের মত। গত ১২ জানুয়ারি দুপুরে মারা যান শাঁওলি মিত্র। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।

ভারতীয় নাট্য জগতের কিংবদন্তি শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের মেয়ে শাঁওলি মিত্রর জন্ম ১৯৪৮ সালে সদ্য স্বাধীন ভারতে। জীবনের প্রথমের দিকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে নিজেই ‘পঞ্চম বৈদিক’ নামে একটি দল গড়েন শাঁওলি। ‘নাথবতী অনাথবত্’, ‘একটি রাজনৈতিক হত্যা’, ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘কথা অমৃতসমান’-এর মত বহু জনপ্রিয় নাটক তিনি উপহার দিয়েছেন। 

তরুণ বয়সেই শাঁওলি মিত্রকে দেখা গিয়েছিল ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি, তক্কো আর গল্প’ সিনেমায়। অভিনয়ের পাশাপাশি লেখক হিসেবেও নিজের আরেকটি পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন শাঁওলি মিত্র। কাজ করেছেন অভিধান সংস্কারে। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলা অকাদেমির প্রধান হিসেবে।

১৯৯১ সালে ‘নাথবতী অনাথবৎ’ বইটির জন্য তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। ২০০৩ সালে পান সংগীত- নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। ২০০৯ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত করে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ২০১৩ সালে তাকে বঙ্গ বিভূষণ খেতাব দেয়। 


সিডনি পোয়াটি

গত ৬ জানুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিশ্বের বড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হলিউডের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ তারকা অভিনেতা অস্কার জয়ী সিডনি পোয়াটি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। তিনি বহুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন বলে জানা গেছে। সিডনি পটিয়ার তার জীবনের শেষ সময়টা কাটান বাহামায়। আর সেখানেই তিনি মারা যান।

সিডনি পোয়াটিরই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ, যিনি সেরা অভিনেতা হিসাবে অস্কার জিতেছিলেন। ১৯৬৩ সালে ‘লিলিস অব দ্য ফিল্ড’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে এই সম্মাননা পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৮ সালে ‘দ্য ডিফায়েন্ট ওয়ানস’ ছবির জন্য প্রথমবার অস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন সিডনি। এদিক থেকে সিডনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা, যিনি অস্কারে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। মনোনয়ন পাওয়ার পাঁচ বছর পর তার ঝুলিতে ধরা দেয় এই পুরস্কার।

  • facebook
  • googleplus
  • twitter
  • linkedin
  • linkedin
  • linkedin