মিয়ানমারের গণতন্ত্র আবারও নির্বাসনে!

ছবি: সংগৃহীত

আবারও অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে দেশটির ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী। গত সোমবার ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির নেত্রী ও স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উ উইন মিন্টসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করার পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন্ট সোয়া এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেন।

সেনাবাহিনীর টেলিভিশন মিয়াওয়াদিতে বলা হয়, ২০০৮ সালের সংবিধান অনুযায়ী আইনসভা, নির্বাহী এবং বিচার বিভাগের ক্ষমতা সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাইংয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জরুরি অবস্থা শেষে নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে সেনাবাহিনী। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে। সু চিসহ অন্য রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ।

গত ৮ নভেম্বর সর্বশেষ মিয়ানমারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সু চির এনএলডি পার্টি ৮৩ শতাংশ আসন পেয়েছে। অন্যদিকে সেনা সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি ৪৭৬টি আসনের মধ্যে মাত্র ৩৩টি আসন পেয়েছে। নির্বাচনের ফলকে সু চির বেসামরিক সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। সেনা অভ্যুত্থানের দিনই এনএলডি সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর কথা ছিল। কিন্তু এর প্রায় এক সপ্তাহ আগে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জেনারেল জাও মিন তুন নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। তিনি জানান, সেনাবাহিনী ১ কোটি ৪ লাখ ভোট জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশন যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে সেনা অভ্যুত্থানও হতে পারে। নির্বাচন কমিশন ভোট কারচুপির অভিযোগ অস্বীকার করার পর সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত গুঞ্জনই সত্যি হয়েছে।

মিয়ানমারে সেনাদের ক্ষমতা দখলের ঘটনা নতুন নয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার পর প্রায় পাঁচ দশক দেশটি শাসন করেছে জান্তা সরকার। ১৯৬২ সালে বেসামরিক প্রশাসন বাতিল করেন জেনারেল নি উইন। এরপর টানা ২৬ বছর সামরিক সরকার ক্ষমতায় ছিল। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, দশকের পর দশক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় এবং অবরোধের কারণে মিয়ানমারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী আবারও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিরতে চাইছিল। একই সঙ্গে চীনের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছিল। এজন্য দেশের ক্ষমতা নিজেদের হাতে রেখেই নামমাত্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় সেনাবাহিনী।

২০১১ সালে জান্তা সরকারের নেতা জেনারেল থান সুয়ে পদত্যাগ করেন। দেশের সংবিধান মেনে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের কাছে তিনি ক্ষমতা ছাড়েন। এর আগে ২০০৮ সালে মিয়ানমারের সংবিধানে দেশটির সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী রাজনৈতিক ক্ষমতা দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর হাতে স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়। পার্লামেন্টে নির্ধারিত আসনের এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির সেনাবাহিনী।

২০১১ সালে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটে। ২০১২ সালের নির্বাচনে সু চির এনএলডি বিরোধী দল হলেও ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে তারা ক্ষমতায় আসে। গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনের জয় লাভ করে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার চালানোর সমর্থন পায় সু চির দল। এ বিষয়টি মানতে পারেনি জেনারেলরা। তারা ভেবেছিল যে সু চির দল ক্ষমতায় আসলেও নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকবে। কিন্তু সু চি প্রেসিডেন্ট না হয়েও যে মিয়ানমারের কার্যত সরকার প্রধানে পরিণত হবেন সেটা তাদের পরিকল্পনায় ছিল না। তারপরও সু চির নেতৃত্ব সহ্য করেছে সেনারা।সু চি ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অন্তত ১৫ বছর বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। তারপরও মিয়ানমারে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তার হাত ধরেই গণতন্ত্র ফিরেছিল মিয়ানমারে। কিন্তু সেনাদের হাত ধরে আবারও নির্বাসনে মিয়ানমারের ভঙ্গুর গণতন্ত্র! গ্রেফতার হওয়ার পর সু চি এক বিবৃতিতে বলেছেন, সেনাবাহিনীর এই ভূমিকা দেশকে একনায়কতন্ত্রে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। জনগণকে আমি অনুরোধ জানাচ্ছি তারা যেন এটা মেনে না নেয়। তারা যেন সেনাবাহিনীর এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। এরই মধ্যে মিয়ানমারে বিক্ষোভ হতে শুরু করেছে। ডাক্তার ও শিক্ষকরা সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। সরকার এক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ করে দিয়েছে। তারপরও বিক্ষোভ চলছে। মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদকে এক অনন্য ঘটনা বলেই মনে করছেন অনেকে।

  • facebook
  • googleplus
  • twitter
  • linkedin
  • linkedin
  • linkedin