শিক্ষার্থীরা দুই বছরের শিখন ঘাটতিতে

ছবি: সংগৃহীত

আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বার খুলতে যাচ্ছে। ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে। ২ মার্চ থেকে খুলবে প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু গত দুই বছর ধরে পাঠ্যবই থেকে কার্যত দূরে থাকা শিক্ষার্থীরা কতটা পরবর্তী স্তরের পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে এটা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

২০২০ সালের মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। গত বছর কিছুদিনের জন্য খুললেও আবার বন্ধ হয়ে যায়। কার্যত দুই বছরের মতো বন্ধ। ২০২০ সালে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিশুরা এবার তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। ফলে এই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে তারা ছিল অনেক দূরে। আবার ২০২০ সালে আবার যারা তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল, চলতি বছর তারা পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে। আবার ঐ দিকে হয়নি পরীক্ষাও। মাধ্যমিক স্তরের এভাবে দুই বছরের শিখন পার্থক্য রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন মুখোমুখি ক্লাসের বাইরে থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখন ঘাটতি (লার্নিং গ্যাপ) তৈরি হয়েছে। বিগত বছরের অনেক আবশ্যকীয় শিখন দক্ষতা অর্জন না করেই শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণিতে উঠে গেছে। এই শিখন ঘাটতি পুষিয়ে নিতে না পারলে সুদূরপ্রসারী ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হবে। বিভিন্ন শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না জানলে ভবিষ্যতে ঐ বিষয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর অনীহা তৈরি হবে। তাই এই ঘাটতি দূর করার জন্য অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা দরকার।

সাইফুল ইসলাম নামে এক শিক্ষক বলেন, স্কুল খোলা আগেই পূর্ববর্তী শ্রেণিসহ বর্তমান শ্রেণির শিখন দক্ষতা অর্জনের নির্দেশনা থাকা উচিত ছিল, যাতে শিক্ষার্থীরা নতুন কিছু শেখার সঙ্গে সঙ্গে আগে শেখার কথা থাকলেও শিখতে পারেনি এমন বিষয়গুলোও আস্তে আস্তে শিখতে পারে। কিন্তু আমরা এর প্রতিফলন দেখছি না।

কিন্তু এই শিশুদের শিখন জ্ঞাপ নিয়ে নির্ধারিত কোন পরিকল্পনা নেই শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, এবারের সেভাবে পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। তবে, শিখন ঘাটতি কমাতে বিকল্প প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে আমরা সুপারিশ করব। এটা প্রকল্প বেইজড লার্নিং হবে।

অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান জানান, গত বছরের মার্চে স্কুল খোলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। ঐ সময়ে এর আগের বছরের সিলেবাস নিয়ে একটি রেমিডিয়াল প্যাকেজ তৈরি করেছিল এনসিটিবি। কিন্তু করোনা সংক্রমণ বাড়ার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়নি। এ কারণে ঐ পরিকল্পনা বাস্তবায়নও করা যায়নি। এর আগে এই শিক্ষাবিদ বলেছিলেন, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান না করার কারণে শিক্ষার্থীদের যে ঘাটতি রয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য শিক্ষাবর্ষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশে এমন উদাহরণ আছে জানিয়েছিলেন।

আর এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, গত বছর আমরা প্রাথমিকের জন্য রেমিডিয়াল প্যাকেজ তৈরি করে দিয়েছিলাম। রেমিডিয়াল প্যাকেজ অনলাইন, রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়েছে। এ বিষয়ে প্রাথমিকের ৩ লাখ ৭৭ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। তবে আগামী ১ মার্চ প্রাথমিক স্কুল খুলবে। এসব শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি দূর করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে কোন পরিকল্পনা চাওয়া হয়নি।

গত বছর যে গাইড লাইন দেওয়া হয়েছিল সেখানে বলা হয়, ক্লাসের শুরুতে শ্রেণিশিক্ষক পাঁচ মিনিট মোটিভেশনাল ব্রিফিং দেবেন। যেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধি, শারীরিক দূরত্বের বিধি, হাত ধোয়ার সঠিক নিয়ম, মাস্ক পরার নিয়ম, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার, কফ ও থুথু ফেলার শিষ্টাচার ইত্যাদি বিষয়ে বলবেন।

শিক্ষাবিদ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষ শিক্ষার্থীর শিক্ষাকাল বা সময় নষ্ট হওয়াটা বা পাঠ পিছিয়ে পড়া সর্বজনীন। এক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও মাধ্যমিকের নিম্নের দুটি স্তর তথ্য প্রাক-প্রাথমিক বা তার ওপরের স্তরগুলোর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। মাধ্যমিকের ওপরের স্তরের যে শিক্ষাসময়ের ক্ষতি এবং পাঠ পিছিয়ে পড়া তা বিশেষভাবে পূরণযোগ্য হলেও প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে তা একটা খুব সহজ নয়। আবার করোনার এই পাঠ ক্ষতি সবার সমান নয়। তিনি বলেন, বিদ্যালয়ে কর্মঘণ্টা বৃদ্ধি করতে হবে। বছরের নির্ধারিত কিছু ছুটি কমাতে হবে। গণিত, বাংলা, ইংরেজি এবং বিজ্ঞানে জোর দিতে হবে। শিক্ষকদেরও বাড়তি কাজের জন্য প্রণোদনা দিতে হবে।

নজরুল ইসলাম নামে একজন অভিভাবক বলেন, শিক্ষার্থীদের ভুলে যাওয়া জ্ঞান ও দক্ষতাজনিত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষকদের ভূমিকার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। তবে এক্ষেত্রে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন এই অভিভাবক।

সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা গণনা ও সাক্ষরতার মৌলিক দক্ষতা হারিয়েছে। বৈশ্বিকভাবে, পড়াশোনায় ব্যাঘাতের অর্থ হলো—লাখ লাখ শিশু শ্রেণিকক্ষে থাকলে যে একাডেমিক শিক্ষা অর্জন করতে পারত তা থেকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বঞ্চিত হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষার্থীদের নিবিড় সহায়তা প্রয়োজন। শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য, সামাজিক বিকাশ এবং পুষ্টি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে স্কুলগুলোকে শুধু শেখানোর নির্ধারিত গণ্ডির বাইরেও যেতে হবে।

  • facebook
  • googleplus
  • twitter
  • linkedin
  • linkedin
  • linkedin