ফাহমিদ উদ্দিন আরিয়ান, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি কলেজ, ঢাকা, বাংলাদেশ-( ‘নগেন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার’- ২০২২-এর একটি নির্বাচিত গল্প)
৩ মে ২০৮৮
“স্যার? মে আই কাম ইন?”
“ডোন্ট ডির্স্টাব মি, মাইকেল!”
“দুঃখিত, স্যার একটি জরুরি বিষয়ে কথা বলার ছিল…”
চেয়ার ছেড়ে ঘুরে দাঁড়ালেন মি.কিয়াংহো। চোখে-মুখে বিরক্তির আভা। দীর্ঘদিন ধরে টাইম ট্রাভেল নিয়ে গবেষণা করছেন মি.কিয়াংহো। তার বানানো স্পেসশীপ মাত্র সাড়ে ৩ বছরে পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরের প্ল্যানেট নেপচুনে অবতরণ করেছে, যার সর্বোচ্চ গতি ছিল সেকেন্ডে ৪৬ কি.মি।
“তোমার আবার কি জরুরি কথা?”
“স্যার? আমার মনে হয় আমি টাইম ট্রাভেলের ফর্মুলা বের করে ফেলেছি।”
“হোয়াট? আর ইউ ম্যাড!!”
“স্যার! আমি একদম ঠিক আছি, আপনি আমার কথা না শুনতে চাইলে আমি স্যার রিচার্ডসনের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলবো।”
কিয়াংহো উত্তেজিত হয়ে মাইকেলের হাত থেকে তার বানানো ফর্মুলাটি নিয়ে দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর জোরে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলেন, “মাই বয়!! এতদিন ধরে পৃথিবীর নামি-দামি বিজ্ঞানীরা যা পারেনি তুমি তা পেরেছ!! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।”
“স্যার, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আমি এটাকে বাস্তবে রূপ দিতে চাই এবং পৃথিবীর প্রথম মানব হিসেবে আমি টাইম ট্রাভেল করবো।”
“তা অবশ্যই আমার বন্ধু জ্যাককে সাথে নিয়ে আমরা ৩ জন পৃথিবীর প্রথম টাইম ট্রাভেল মেশিন তৈরি করবো। আজকে থেকেই শুরু করে দিতে হবে।”
“কিন্তু!”
“কিন্তু কি?”
“স্যার, আমার তৈরি ফর্মুলা দিয়ে টাইম ট্রাভেল ঠিকই হবে। কিন্তু ফিরে আবার আসা যাবে কিনা এই নিয়ে সন্দেহ। আর ফিরে না আসতে পারলে মৃত্যু নিশ্চিত।”
“ফিরে আসার জন্য তো তুমি একটা ফর্মুলা দিয়েছ, আর আমার গবেষণা বলছে অবশ্যই ফিরে আসা যাবে।”
মাইকেল কিছুটা হেটে গিয়ে স্যার কিয়াংহোর জানালার দিকে দাঁড়ালেন। অদূরের সূর্যাস্ত দেখতে-দেখতে মাইকেল অস্ফুট স্বরে বলল,”কি সুন্দর দৃশ্য!”
#
১১ মে ২০৮৮
স্যার কিয়াংহো বেশ উৎফুল্ল। তাদের ফর্মুলানুযায়ী টাইম ট্রাভেলার বানানো শেষ। তিনি স্বপ্নে বিভোর, কেননা ইতিহাসে টাইম ট্রাভেলার এর ৩ জন উদ্ভাবকের মধ্যে তার নাম লেখা থাকবে। সিগেরেটের ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে মাইকেলকে বললেন, “মাইকেল?”
“জি স্যার?”
“তুমি চিন্তিত!!” সিগেরেটের বাক্সটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নাও। এইটা খুবই রেয়ার পিস, জার্মানি থেকে আনানো।”
মাইকেল সিগেরেটটা নিয়ে খেলো না, হাতেই রেখে দিলো।
“মাইকেল? হোয়াই আর ইউ লুকিং সো টেন্সড; মাই স্যান?”
“স্যার, আমি ফিরে আসবো তো?”
কিয়াংহো উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন। বিদঘুটে হাসি, “শোনো, তুমি ইম্পসিবলকে পসিবল করেছো। আমি আর জ্যাক দীর্ঘ অনেক দিন যাবৎ টাইম ট্রাভেল নিয়ে গবেষণা করছি। তোমার ভয় নেই, তোমার সাথে আমরা কানেক্টেড থাকবো ওয়ারলেস মডিউল দিয়ে। তুমি অযথাই…”
মাইকেল মানিব্যাগ থেকে তার মা’র ছবির বের করে তাকিয়ে আছে, অপলক দৃষ্টিতে।
“আচ্ছা? কিছু ঠিক করেছো, মাইকেল?”
“বুঝতে পারিনি…”
“কোথায় যাবে? কোন কালে যাবে?”
“জি, ঠিক করেছি। আমি আমার মাকে কখনো দেখতে পারিনি জন্মের পর। তাই অতীতে যাবো। আজ থেকে ২৪ বছর ৪ মাস আগে যাবো…”
“আমি তোমার জায়গায় থাকলে ভবিষ্যতে যেতাম।”
“বাবার কাছ থেকে শুনেছিলাম, মা নাকি এক্সিডেন্ট করে। তখন তার কোলে আমি ছিলাম…”
“আই এম সরি…”
মাইকেলের থেকে তার মা’র ছবিটা হাতে নিয়ে কিয়াংহো অস্ফুট স্বরে বলে ফেললো, “বিউটিফুল লেডি…”
মাইকেল কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে স্যার কিয়াংহো থেকে ছবিটা নিয়ে নিলো।
“স্যার, আমি অতীত যাত্রা কবে করছি তাহলে?”
“১৬ মে।”
মাইকেল কিছুটা চিন্তিত। তাকে তাড়া করছে তার মা’কে প্রথমবারের মতো দেখার এক অদ্ভুত উত্তেজনা।
“স্যার, আজ আমি উঠি। আপনি শেষবারের মতো টাইম ট্রাভেলার পরীক্ষা করুন।”
“তুমি যেতে পারো, আমি আমার এসিস্ট্যান্ট রবো.এক্সকে বলছি তোমাকে বাসায় পৌছিয়ে দিবে।”
“ধন্যবাদ। আমি একা যেতে চাই। বিচে কিছুক্ষণ সময় কাটাবো।”
মাইকেল বেশ চিন্তিত। অজানা আতঙ্ক তাকে গ্রাস করেছে। আদৌ কি মানব ইতিহাসের প্রথম মানব হিসেবে মাইকেল অতীতে যাত্রা করতে পারবে? মিশন সাকসেসফুল হবে তো?
#
১৬ মে ২০৮৮, পুরো পৃথিবীর অসংখ্য টিভি একসাথে সম্প্রচার শুরু করে দিয়েছে। সবাই তাকিয়ে আছে এক মাইকেলের দিকে। শেষ পর্যন্ত কি তাহলে মানুষ পেরে গেলো, টাইম ট্রাভেল করতে? মাইকেলকে স্যাট পড়িয়ে দেওয়া হল, অসংখ্য সেন্সর তাকে আবৃত করে রেখেছে। কিয়াংহো বেশ উৎফুল্ল, “হ…আজকে মানবজাতির স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে তোমাকে দিয়ে। তোমার সাথে ক্যামেরা, ওয়ারলেস মডিউল আছে। তবে তুমি অতীত থেকে কিছু আনতে পারবে না। আর হ্যাঁ, ঠিক২৪ মিনিট থাকবে তোমার কাছে। আমরা তোমাকে এলার্ম করবো এখানে বসে, লেইট করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
মাইকেল “হ্যাঁ / না” কিছুই বলল না। নির্বিকার। স্যার কিয়াংহোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শুধু হাতটা মিলিয়ে সে আবদ্ধ টাইম ট্রাভেলারে উঠে গেলো। তার সঙ্গী তার মায়ের ছবিটা।
“টেন… নাইন… এইট… সেভেন…টু… ওয়ান!!!”
ট্রাভেলার থেকে প্রকাণ্ড শব্দ হতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর সবকিছু শান্ত। কিয়াংহো সময় গুনছেন আর মাইকেলকে ট্রেস করছেন।
“মাইকেল এখন ২০৮০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পার করছে।” কিছুক্ষণ পর, “আমরা খুব কাছাকাছি। টার্গেট অনুযায়ী আজকে থেকে ঠিক ২৪ বছর ৪ মাস আগে মাইকেল পৌঁছে গিয়েছে। সে এখন মোনাকোতে আছে।”
বিশ্বের সব টেলিভিশন দেখাচ্ছে মানুষের প্রথম টাইম ট্রাভেল যাত্রা।
“হ্যালো? মাইকেল? তোমার কাছে আর ১৭ মিনিট ২১ সেকেন্ড আছে।”
“স্যার, আমি দৌড়াচ্ছি। আশে পাশের মানুষ উদ্ভট চোখে তাকিয়ে আছে। আমি টার্গেট খুঁজছি, মোনাকো সিটি হসপিটাল…”
“তোমার জায়গা থেকে আর ৪৫ গজ দূরে আছে টার্গেট। ১৩ মিনিট ১২ সেকেন্ড আছে আর।”
কিয়াংহোকে চিন্তিত দেখাচ্ছে প্রথমবারের মতো। কিয়াংহো সময় হিসাব করলেন। আর ৮ মিনিটের মধ্যে মাইকেল ট্রাভেলারে না ফিরলে সব শেষ হয়ে যাবে।
“মাইকেল? আমি যা বলছি শুনো। ইটস এ্যান অর্ডার। তুমি এখনই ট্রাভেলারে ফিরো। আর ৭ মিনিট তোমার কাছে…”
“স্যার!!মা’কে পেয়েছি। আমি পেয়েছি।”
“মাইকেল! তুমি পারবে না। এখনই ট্রাভেলারে ফিরে এসো।”
মাইকেলের মা অতীতে এক নবজাতককে কোলে নিয়ে পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ করে এক ট্রাক গতি হারিয়ে তার মা’র দিকে আসতে থাকে। মাইকেল সুদূর অতীতে চোখের সামনে ঘটতে দেখছে এসব। মা’কে বাঁচাতেই হবে। সে দৌড়াতে থাকে তার মা’র দিকে। অনেক কাছে। মা তখন বুঝতে পারে সময় নেই আর, সাথে-সাথে থাকা বাচ্চাটাকে দূরে সরিয়ে দেয়। ঠিক তখন মাইকেল তার মা’কে স্পর্শ করে। সময় আর থাকে না। সেখানেই মৃত্যু হয় মাইকেলের।
“মাইকেল। তুমি কি আছো? “
প্রেসিডেন্ট, মাইকেলে সাথে আমরা যোগাযোগ হারিয়েছি। আমরা ব্যর্থ।”
দীর্ঘ ৭ বছর পর কিয়াংহো রোলিং চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার মনে হল, “মাইকেলের সাথে কোন ভুল হয়নি তো?” সাথে সাথে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তার নিজ ডাটাবেইসে খুঁজতে লাগলেন ২০৬৩ সালের আগস্ট মাসের দৈনিক খবরগুলো। হঠাৎ একটা খবর দেখে সাথে-সাথে আঁতকে উঠলেন, ‘মোনাকো সিটি-হসপিটাল সংলগ্ন পার্কিং লটে এক মা’র ও এক অজ্ঞাতনামার ট্রাক চাপায় করুণ মৃত্যু’। কিয়াংহো সবটা খবর পরে দেখলেন, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির শরীরে অনেক সেন্সর পাওয়া গিয়েছিলো, যেসব ছিল অনেক উন্নত। এমনকি যা আবিষ্কার ও হয়নি তখন।
কিয়াংহো অবাক। তার মানে কি?
আমরা কোথায় আছি? আমরাই কি বর্তমানে? নাকি কিয়াংহোর মতো আরেকজন সুদূর অতীতে বসে আরেক টাইম ট্রাভেলারের ছক কষছে। আরেকবার ভবিষ্যতের মাইকেল আসছে আমাদের সময়ে। কে জানে। প্রশ্ন থেকেই যায়। এই পৃথিবী অনেক বিস্ময়কর, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
( সমাপ্ত )